Monday, October 14, 2013

গোশতের ভালো-মন্দ

গোশত আমিষপ্রধান একটি খাবার। আমিষ ছাড়াও এতে আছে চর্বি ও নানা রকমের ভিটামিন এবং খনিজ লবণ। মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে কোরবানির ঈদ। এই ঈদের অন্যতম একটি ইবাদত হচ্ছে পশু কোরবানি করা। সে জন্য কোরবানির ঈদে গোশত খাওয়ার প্রবণতা অন্যান্য সময় থেকে অনেক গুণ বেড়ে যায়। সাধারণত কোরবানির পশু হিসেবে গরু, মহিষ অথবা খাসি নির্বাচন করা হয়। গোশত কতটা স্বাস্থ্যকর এ নিয়ে নানা রকমের বিতর্ক রয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ওবেসিটি একটি বড় সমস্যা, সেই সঙ্গে ওই সব দেশে হার্টের রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি। তাই তারা গরু, মহিষ অথবা খাসির গোশত অনেকটাই এড়িয়ে চলে। যদিও কখনো খায়, তাহলে লিন মিট বা চর্বিবিহীন অংশটাকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোতে গোশত খাওয়া হয় উৎসবে অথবা কালেভদে। এ ছাড়া ওবেসিটির মতো সমস্যা আমাদের দেশে এখনো প্রবল আকার ধারণ করেনি, তাই মাঝেমধ্যে গোশত খাওয়া আমাদের জন্য ভালো বৈ মন্দ নয়।

গোশতের ভালো দিক

আমিষের অন্যতম উৎস : প্রতি ১০০ গ্রাম গরু, মহিষ অথবা খাসির গোশত থেকে ২০-২৫ গ্রাম আমিষ পাওয়া যায়। গোশতের আমিষের গুণগত মান অন্যান্য উদ্ভিজ আমিষের তুলনায় অনেক উন্নত। গোশতের আমিষে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব অ্যামিনো এসিড আছে। শিশুদের আমিষের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা রোধে খিচুড়িতে গোশত যুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া যাঁদের ওজন কম তাঁরাও সপ্তাহে কয়েক দিন গোশত খেতে পারেন।

আয়রনের প্রধান উৎস : আয়রন অত্যন্ত দরকারি একটি খনিজ লবণ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মহিলা আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। গোশত আয়রনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। গোশতের আয়রনকে হিম আয়রন বলে, যা উদ্ভিজ নন হিম আয়রনের তুলনায় গুণগতভাবে অনেক উন্নত। প্রতি ১০০ গ্রাম গোশত প্রতিদিনের আয়রনের চাহিদার ২৫ শতাংশ মেটাতে সক্ষম।

অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ লবণের উৎস : গোশত ভিটামিন বি-৬, নায়াসিন, ভিটামিন বি-১২, ফসফরাস ও জিংকের অত্যন্ত ভালো উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম গোশত এসব ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রতিদিনকার চাহিদার ২৫ শতাংশ মেটাতে সক্ষম। এ ছাড়া রিবোফ্লাভিন, প্যান্টোথেনিক এসিড ও সেলেনিয়ামের চাহিদা মেটায় ১০ শতাংশেরও বেশি। খাসির গোশতে এসব ভিটামিন ও খনিজ লবণের পরিমাণ অন্যান্য গোশতের চেয়ে বেশি থাকে।

গোশতের ক্যালরি-মূল্য : প্রতি ১০০ গ্রাম গোশত থেকে রকমভেদে ৪৯৮ থেকে ৫১৪ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। তাই শক্তির জন্য গোশত খাওয়া যায় সপ্তাহে এক বা দুই দিন।



বিভিন্ন অঙ্গের পুষ্টিগুণ

* গরু, মহিষ অথবা খাসির বিভিন্ন অঙ্গের আছে নানা রকমের পুষ্টিগুণ। লিভার, হার্ট, কিডনি ও মগজ নানা রকমের ভিটামিন ও খনিজ লবণে বেশ সমৃদ্ধ।

* সব রকমের গবাদি পশুর মাংসে ভিটামিন বি-১২ আছে প্রচুর পরিমাণে। প্রতি ১০০ গ্রাম অর্গান মিট প্রতিদিনকার ভিটামিন বি-১২-এর চাহিদার ১০০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম।

* লিভার আমিষ, আয়রন, ফলিক এসিড, জিংক, রিবোফ্লাভিন, নায়াসিন ও ভিটামিন-এ-এর উত্তম উৎস।

* কিডনি আমিষ, আয়রন থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন ও ফলিক এসিডের ভালো উৎস।

* হার্ট থেকে পাওয়া যায় আয়রন ও জিংক, তবে তা লিভার ও কিডনির তুলনায় কম।

* সব অর্গান মিটে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল আছে, বিশেষত মগজে কোলেস্টেরলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।


গোশতের মন্দ দিক

চর্বির আধিক্য : যদিও কিছু পরিমাণ চর্বি সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকার, গোশতের চর্বির মাত্রা বেশি হলে তা শরীরের জন্য খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। তাই গোশত কাটা এবং খাওয়ার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান চর্বি ফেলে দেওয়া ও না খাওয়াই উত্তম। কেননা অতিরিক্ত চর্বি হার্টের অসুখসহ নানা রকম শারীরিক অসুবিধার কারণ হতে পারে। খাসির গোশতে চর্বির পরিমাণ অন্যান্য গোশতের তুলনায় বেশি- তাই যাদের হার্টের সমস্যা বা ওজন বেশি তাদের খাসির গোশত পরিহার করা উচিত।

কোলেস্টেরলের উপস্থিতি : গোশতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকে, যার অতিরিক্ত গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষত গবাদি পশুর মাংসে কোলেস্টেরল থাকে বেশি। মগজ ও খাসির মাংসে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অত্যধিক। তাই পারতপক্ষে এগুলো না খাওয়াই ভালো।

সতর্কতা

পেট ফাঁপা ও কিডনিতে পাথর হলে গোশত একেবারে বাদ দিতে হবে। বাত হলে মগজ, গুর্দা, কলিজা ও সংরক্ষণ করা গোশত নিষেধ। তবে তাজা গোশত পরিমিত খেলে ক্ষতি নেই। কিডনির অসুখ ও হার্টের অসুখে গোশত যত কম খাওয়া যায় তত ভালো। লিভার, গলব্লাডার ও প্যানক্রিয়াসের অসুখে প্রাণিজ চর্বি বাদ দেওয়া উচিত। যাদের ওজন বেশি তাদের গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকা দরকার। প্রতিদিন ৯০-১০০ গ্রামের বেশি প্রাণিজ আমিষ না খাওয়াই ভালো।


ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়েট সলিউশন
www.dietsolutionbd.com

মাংসের নতুন বিপদ
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গবাদিপশু বিশেষ করে গরু মোটাতাজা করার প্রচলন বহু দিন থেকেই। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক উপায়ে গরু মোটাতাজা করার পরিবর্তে স্টেরয়েড ও হরমোন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর সঙ্গে প্রয়োগ করা হচ্ছে বিভিন্ন অ্যান্টিহিস্টামিন ও ভিটামিনের উচ্চ মাত্রা। এতে গরু দ্রুত মোটাতাজা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু মানুষের জন্য তৈরি করেছে নতুন বিপদ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ল্যাবএইড, গুলশান, ঢাকার সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. জুলহাস উদ্দিন জানান, বিভিন্ন জটিল রোগে যখন অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগে ফল পাওয়া যায় না, শুধু সে ক্ষেত্রেই স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। কোনো অবস্থাতেই সুস্থ মানুষের শরীরে তা প্রয়োগ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু গরুর মতো গবাদিপশুর শরীরে ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকর্টিসনের মতো স্টেরয়েড প্রয়োগ করলে তা মাংসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, ব্রেনস্ট্রোক, অ্যাথেরোস্ক্লোরোসিস, লিভার ও কিডনির অসুখ তৈরি করতে পারে। মাংস খাওয়ার মাধ্যমে অল্প বয়সী শিশুরাও এ ধরনের অসুখের ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ স্টেরয়েড রান্নার তাপে নষ্ট হয় না। এ ছাড়া গরুর শরীরে প্রয়োগ করা বিভিন্ন হরমোন মানবদেহে বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতা তৈরি করতে পারে। এমনিতেই গরু-খাসির মাংসে যথেষ্ট ক্ষতিকর দিক রয়েছে, তাই নতুন ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে মোটাতাজা গরুর মাংস এড়িয়ে চলাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

No comments:

Post a Comment